(Bengali Language)
শাস্ত্রপাঠ: মথি ৯:৯—১৩
“৯ আর সেই স্থান থেকে যেতে যেতে যীশু দেখলেন, মথি নামক এক ব্যক্তি করগ্রহণ-স্থানে বসে আছে; তিনি তাকে বললেন, আমাকে অনুসরণ কর। তাতে সে উঠে তাঁর পিছনে পিছনে চলতে লাগল। ১০ পরে তিনি বাড়ির মধ্যে ভোজন করতে বসেছেন, আর দেখ, অনেক কর—আদায়কারী ও পাপী এসে যীশুর এবং তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে ভোজনে বসলো। ১১ তা দেখে ফরীশীরা তাঁর শিষ্যদেরকে বললো, তোমাদের গুরু কি জন্য কর-আদায়কারী ও পাপীদের সঙ্গে ভোজন করেন? ১২ তা শুনে তিনি বললেন, সুস্থ লোকদের চিকিৎসকের প্রয়োজন নেই, বরং অসুস্থদেরই প্রয়োজন আছে। ১৩ কিন্তু তোমরা গিয়ে শিক্ষা কর, এই বাক্যের মর্ম কি, “আমি করুণাই চাই, উৎসর্গ নয়”; কেননা আমি ধার্মিকদেরকে নয়, কিন্তু পাপীদেরকে ডাকতে এসেছি।”
ভূমিকা:
যীশু এই কারণেই যীশু যুগের পর যুগ ধরে, শত শত বছর ধরে এমন কি হাজার ধরে মহান যীশু হিসাবে লোকদের মনে অধিষ্ঠিত কারণ তিনি পাপীদের ভালবাসতেন, তাদের গ্রহণ করতেন, তাদের বুঝতে চেষ্টা করেছেন, এমন কি নিজের জীবন দিয়ে তার ভালবাসার প্রমাণ রেখেছেন।
আজকের শাস্ত্র পাঠের উপর আলোচনা:
আমরা দেখতে পাই যে, যীশু তাঁর নিজের নগরে একজন পক্ষঘাত রোগীকে এই কথা বলে সুস্থ করলেন যে, “তোমার পাপ ক্ষমা হল।” এই কথা বলার জন্য ফরীশীদের কাছ থেকে অনেক সমালোচনা শুনতে হয়েছে। সেখান থেকে যেতে যেতে একজন পাপী মানুষকে দেখেছিলেন যার পরিত্রাণের প্রয়োজন, আর মানুষ তাকে দেখত মথি— একজন কর-আদায়কারী হিসাবে, যে রোমীয় সরকারের জন্য কর আদায় করে। লোকেরা তাকে ঘৃণা করত যেমন অন্য সকল কর-আদায়কারীকে করে থাকে। প্রধানত তিনটি কারণে লোকেরা তাদের তিক্ততার সঙ্গে ঘৃণা করতো।
মথি ৯:৯ পদ — মথির কনভারশন: একজন পাপীর একজন উদ্ধারকর্তার প্রয়োজন ছিল
চিন্তা ১: মথি একজন কাজের মানুষ ছিলেন, খুবই কর্মচঞ্চল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অলস ও ধীরগতি সম্পন্ন ছিলেন না। দৃশ্যতঃ তিনি তার কাজ নিয়ে আত্মিক ভাবে খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না, কিন্তু তবুও জাগতিকভাবে তিনি কাজের, কঠিন পরিশ্রমের মানুষ ছিলেন। যীশুর কাছে কোন অলস ব্যক্তির জায়গা ছিল না।
চিন্তা ২: একটি নাটকীয় পরিবর্তন মথির জীবনে এসেছিল। ১. যীশুর ডাক ছিল পরিস্কার ও শক্তিশালী ও অতুলনীয়: “আমাকে অনুকরণ কর”। ২. মথির সাড়াও ছিল পরিস্কার ও শক্তিশালী, অতুলনীয়: “তিনি ওঠলেন ও তাঁকে অনুসরণ করলেন”।
চিন্তা ৩: যে কোন ধনী মানুষের পক্ষেই ঈশ্বরের রাজ্যে আসা খুবই কঠিন কারণ তারা এই জাগতিক জীবনের সঙ্গে ভীষণ ভাবে জড়িত থাকে। মথি সেই সমস্ত ধনী লোকদের মধ্যে একজন অন্যতম মানুষ যিনি এই জাগতিক ঐশ্বয্য, জাঁকজমক, জাগতিক সুখভোগ এককথায় ছেড়ে দিতে রাজী হয়েছেন খ্রীষ্টকে অনুসরণ করার জন্য। এইজন্যই স্বর্গ-রাজ্যটি তার হয়েছে— পরিত্রাণ তার বাটিতে উপস্থিত হয়েছে (মথি ১৯:২৩—২৬)
চিন্তা ৪: মথি সর্বান্তকরণে যীশুকে অনুসরণ করেছিলেন। যখন থেকে তিনি যীশুকে অনুসরণ করতে রাজী হয়েছেন, তার পর থেকে তিনি কখনও ফিরে যান নি।
চিন্তা ৫: মথির কনভারশন দেখায় যে, যারা যীশুকে সত্যিই অনুসরণ করে তিনি তাদের সকলকে পরিত্রাণ দান করে থাকেন: যারা ঘৃণিত, যারা অবিবেচক, যারা সন্ত্রাসী, যাদের যীবনে কোন উদ্দেশ্য নেই, যারা তিক্ত, যাদের জীবনে কোন তৃপ্তি নেই, যারা চোর, যারা কোন ধর্ম—জীবন যাপন করে না, যারা একাকী, যারা অনৈতিক, — মথির মত এমন সকলে যারা সত্যি সত্যি যীশুকে অনুসরণ করতে চায় যীশু তাদের সকলের জীবনে পরিত্রাণের স্বাদ যুক্ত করেন।
মথি ৯:১০–১১ — সাক্ষ্যদান: একজন পাপী যিনি তার অন্যান্য পাপী বন্ধুদের যীশুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
৯:১২—১৩ খ্রীষ্টের মিশন: “তা শুনে তিনি বললেন, সুস্থ লোকদের চিকিৎসকের প্রয়োজন নেই, বরং অসুস্থদেরই প্রয়োজন আছে, কিন্তু তোমরা গিয়ে শিক্ষা কর, এই বাক্যের মর্ম কি, “আমি করুণাই চাই, উৎসর্গ নয়”; কেননা আমি ধার্মিকদেরকে নয়, কিন্তু পাপীদেরকে ডাকতে এসেছি।” — যেন এই বিষয়টি পরিষ্কার হয় যে, “পরিত্রাতা পাপীদের ত্রাণ করেন”।
প্রথমত: মথি সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন যে, তিনি একজন পাপী, এবং তার পাপী বন্ধুরা যারা আত্মিকভাবে অসুস্থ, এবং যাদের জীবনে ঈশ্বরের অনুগ্রহের প্রয়োজন আছে এরকম বন্ধুরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের জীবনে একজন পরিত্রাতার প্রয়োজন ছিল, এবং তারা জানতেন যে, যীশু একজন পরিত্রাণকর্তা। তারা বিশ্বাস করেছিল যে, যীশু পাপীদের পরিত্রাণ করতে এসেছেন।
দ্বিতীয়ত: যীশু ধর্ম—নেতাদের সাবধান করেছিলেন যারা মনে করতো যে, তারা অন্যান্যদের চেয়ে ঈশ্বরের কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য।
যীশুর মিশন কি ছিল?
“যেমন মনুষ্যপুত্র পরিচর্যা পেতে আসেন নি, কিন্তু পরিচর্যা করতে এবং অনেকের পরিবর্তে আপন প্রাণ মুক্তির মূল্যরূপে দিতে এসেছেন।” মথি ২০:২৮
“কারণ যা হারিয়ে গিয়েছিল, তার খোঁজ ও পরিত্রাণ করতে মনুষ্যপুত্র এসেছেন।” লূক ১৯:১০
তিনটি উদ্দেশ্য এই স্থান থেকে পাওয়া যায়:
ঈশ্বর চান যেন আমরা মানুষকে করুণা ও দয়া করি, মমতা করি। আমরা তাঁর কাছে যত উৎসর্গই করি না কেন, তাতে তিনি খুশী হন না। তিনি খুশী হন যখন আমরা মানুষকে ভালবাসি, তাকে দয়া করি, অনুগ্রহ করি, ক্ষমা করি, ও তাকে নিজের মত ভালবাসি— এটাই মানুষের আসল উপাসনা।
উপসংহার:
আমরা যারা যীশুর কাছে আসতে চাই আমরা কি ভাবি যে, যীশু আমাদের আহ্বান করছেন? আমরা কি নিজেদের আত্মিকভাবে অন্ধ, পাপী ও অযোগ্য মনে করছি। যীশু মথিকে যেভাবে দেখতে পেয়েছিলেন আমরা কি সেরকম— নাকি তার চেয়ে অনেক ভাল বলে নিজেকে মনে করছি?
মথি পাপ থেকে মন ফিরিয়ে ছিলেন এবং সকলেই তা দেখতে পেয়েছিল। তিনি সাক্ষ্য দিতে গিয়ে নিজের পয়শা খরচ করে ভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন যেখানে তার বন্ধুরা ছিলেন। আমরা কি আমাদের নিজেদের পয়শা দিয়ে সাক্ষ্য দিই না কি মিশনের পয়শা দিয়ে সাক্ষ্য দিই ও সেই কাজের জন্য শ্রমের মূল্যও চাই বেতন হিসাবে। মথি আমাদের সকলের কাছে একজন আদর্শ হোক এই কামনা করি।
শাস্ত্র পাঠ: যোহন ১৫:১৩-১৪
“কেউ যদি আপন বন্ধুদের জন্য নিজের প্রাণ দেয়, তবে তার চেয়ে বেশি প্রেম কারো নেই। আমি তোমাদেরকে যে সমস্ত আদেশ দিচ্ছি, তা যদি পালন কর, তবে তোমরা আমার বন্ধু।”
ভূমিকা:
আজকাল মিডিয়াতে প্রায়ই বন্ধুত্বের শ্লোগান শোনা যায় বিশেষ করে মোবাইল ফোনের এডগুলোতে। সত্যি মানুষের জীবনে বন্ধু দরকার। বন্ধু ছাড়া জীবন যেন একাকীত্বের ঘন জঙ্গলে বসবাস। এক জীবনের কাল একেবারে কম সময় নয়। জীবন কালের এই সময়টুকুতে জীবনের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে জীবন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়। এই সময়টুকুতে আসল-নকল, বন্ধু-শত্রু, সময়ের বন্ধু, অসময়ের বন্ধু ইত্যাদি সম্বন্ধে আমাদের সাম্যক অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয়। এই অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বুঝতে পারি কে আমাদের সত্যিকারের বন্ধু আর কে আমাদের মৌসুমি বন্ধু। পবিত্র বাইবেলে বন্ধুত্বের এই সব নিদর্শনের দারুন দারুন ঘটনা-প্রবাহের চিত্র আমাদের নজর কেড়ে নেয়—আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
পুরাতন নিয়মে বন্ধুত্বের উদাহরণ:
১. ইস্কোল ও আনেরের ভাইয়ের সঙ্গে অব্রাহামের বন্ধুত্ব:
বন্ধুত্বের একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত আমরা অব্রাহামের জীবনে দেখতে পাই। ঈশ্বরের আহ্বানে তিনি তাঁর জন্মভূমি ছেড়ে তৎকালীন কনান দেশে এসে বাস করছেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর সন্তানতুল্য ভাতিজা লোটও তাঁর সহযাত্রী হয়েছেন। এক সময় স্থানের সংকুলান না হওয়ার কারণে অব্রাহাম ও লোট একে অপরের থেকে পৃথক হয়ে বাস করতে শুরু করেন। এমনই এক অবস্থায় লোট যখন সাদোম শহরে বাস করছিলেন তখন পার্শ্ববতীর্ এলাকার রাজারা সদোম আক্রমণ করে, সেই সঙ্গে লোটের সমস্ত সম্পত্তি সহ তাকে ও তার পরিবারের লোকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই খবর যখন অব্রাহামের কাছে এসে পৌঁছায় তখন তিনি ও তাঁর প্রশিক্ষণ পাওয়া যোদ্ধারা এবং তিনি যাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন তাঁর ডাকে তারাও তাঁর সঙ্গে লোটকে উদ্ধারের কাজে যোগ দেন। আমরা দেখতে পাই যে, বন্ধুদের সাহায্যে তিনি লোট, তাঁর পরিজন ও ধন-সম্পত্তি সহ সমস্ত কিছু উদ্ধার করে আনেন। তারা যে শুধু লোটকে উদ্ধার করেছেন ত-ই নয়, সেই সমস্ত রাজাদের ধন-সম্পত্তিও লুট করে নিয়ে এসেছিলেন।
এখানে আমরা দেখতে পাই সত্যিকারের বন্ধুত্বের পরিচয়। এই কাজে রিক্স আছে জেনেও সেই বন্ধুরা তার সহযাত্রী হয়েছিল। এটাই আসল বন্ধুত্বের পরিচয়। প্রয়োজনের সময়ে বন্ধুরা এগিয়ে আসে। হাতে হাত রাখে।
২. দায়ূদ ও যোনাথনের বন্ধুত্ব:
বন্ধুত্বের আরেকটি চমৎকার ঘটনা দেখতে পাই দায়ূদ ও যোনাথনের বিবরণের মধ্যে। এঘটনা হয়তো আমরা অনেকেই জানি কারণ এটা নিয়ে আমরা প্রায়ই প্রচার করে থাকি। যেমনি যোনাথন সারা জীবন এই বন্ধুত্বের মূল্য বজায় রেখেছেন তেমনি দায়ূদও এই বন্ধুত্বের মূল্য বজায় রেখেছেন। দায়ূদ যখন শৌলের তাড়া খেয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তখন সেই গভীর জঙ্গলে এসে যোনাথন দায়ূদের হাত শক্তিশালী করেছিলেন, তাঁর মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে যোনাথনের মৃত্যুতে দায়ূদ ভীষণভাবে শোকাহত হয়েছিলেন। দায়ূদ রাজা হবার পরে যোনাথনের কথা মনে করেই শৌলের পরিবারের কে কোথায় আছে তা জানতে চেয়েছেন। যোনাথনের ছেলে মফিবোসৎকে তিনি নিজের পরিবারের একজন করে নিয়েছিলেন এবং তার রাজপরিবারের টেবিলে বসে খেতে ও রাজ বাড়ীতে থাকবার ও রাজকীয় সুবিধা ভোগ করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এটাই বন্ধুত্বের মূল্য।
৩. দায়ূদ ও বর্সিল্লয়ের বন্ধুত্ব:
দায়ূদের আরও কয়েকজন বন্ধু ছিলেন। এরা ইসরাইলীয় ছিল না কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশের বাসিন্দা ছিল। এদের মধ্যে গিলিয়দীয় বর্সিল্লয় রোগলীম ছিলেন অন্যতম। দায়ূদের যখন সত্যিকারের বিপদ— তাঁর ছেলে তার রাজ্য দখল করে নিয়েছে। তিনি মরুএলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন— সঙ্গে তাঁর আরও অনেক লোক। এই মুহূর্তে তাদের বড় সংকট খাবারের যোগান। এই বর্সিল্লয় তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনেক রকমের খাবার তিনি এই পুরো দলের জন্য যোগান দিয়েছিলেন। দায়ূদ যখন আবার তাঁর রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন তখন তিনি তার কথা ভুলে যান নি। তিনি বন্ধুত্বের মূল্য দিয়েছিলেন। দায়ূদ তাকে রাজধানীতে আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন তার সঙ্গে বাস করার জন্য।
এছাড়া, আমরা দানিয়েলের তিন বন্ধুর কথা জানি। ক্ষমতার কারণে আমরা তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ভাঙ্গনের কোন কারণ দেখতে পাই না। যদিও বুদ্ধিতে, জ্ঞানে, বিজ্ঞতায় ও রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় অন্যদের চেয়ে দানিয়েল অনেক উপরে ছিলেন তবুও দানিয়েল সারা জীবন এই বন্ধুত্ব রক্ষা করেছেন ও তাদের বিপদে তিনি এগিয়ে এসেছেন ও তাদের উন্নতির চেষ্টা করেছেন।
নতুন নিয়মে যীশু ছিলেন পাপীদের বন্ধু:
নতুন নিয়মে যীশুর একটি টাইটেল হল— পাপীদের বন্ধু: নতুন নিয়মে যীশুকে বলা হয়েছে, “ঐ দেখ, এক জন পেটুক ও মদ্যপায়ী, কর-আদায়কারীদের ও পাপীদের বন্ধু।” যীশু ছিলেন পতিত মানুষের প্রকৃত বন্ধু— নিজের জীবন দিয়ে তিনি তা প্রমাণ করে গেছেন। যীশুর নিজেরও একজন বন্ধু ছিল যাকে আমরা লাসার বলে চিনি— যে লাসারের বাড়িতে যীশু বিশ্রামের জন্য যেতেন। লাসার তাঁর যত্ন নিতেন। এই লাসারকে তিনি মৃত্যু থেকে জীবনে ফিরিয়ে এনেছিলেন।
নতুন নিয়মে নির্ভেজাল বন্ধুত্বে উদাহারণ: বন্ধুর অনেক উদাহরণ পবিত্র বাইবেলে আছে। যেমন ভাল বন্ধুর উদাহরণ আছে তেমনি মন্দ বন্ধুর উদাহরণও আছে। এমন অনেক বন্ধু আছে যারা বন্ধুর জীবনের ধ্বংসের কারণ হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু বন্ধু যে প্রয়োজনের সময়ে হিতকর হয়, মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসে সেই প্রকৃত বন্ধু। আজকে পবিত্র বাইবেলের নতুন নিয়ম থেকে এমন কয়েকজন বন্ধুর কথা বলতে চাই যারা কোন রাজ-রাজা বা কোন নামীদামী কোন লোককের বন্ধু নয় কিন্তু এমন একজন লোকের বন্ধু যে অনেক বছর যাবৎ অবশ-রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। যদিও এই ঘটনায় তার সামাজিক স্টেটাস দেওয়া হয় নি তবুও এ কথা বুঝা যায় যে সে অতি দরিদ্রই ছিল। কিন্তু তার কয়েকজন ভাল বন্ধু ছিল। যদিও সেই ঘটনায় বন্ধু শব্দটির উল্লেখ নেই তবুও ঘটনা পরম্পরায় দেখা যায় তারা তার সত্যিকারের বন্ধু ছিল— যারা তার মঙ্গল চেষ্টায় কম কিছু করেন নি। মার্ক ২:১—১১ পদ পাঠ করলে এই নির্ভেজাল বন্ধুত্ব সম্বন্ধে জানা যাবে।
এই ঘটনায় আমরা অবশ-রোগী ছাড়াও আমরা আরও চারজন লোক দেখতে পাই যারা খাটিয়া বহন করে নিয়ে এসেছিল। আমরা জানি না তারা কত দূরে থেকে এসেছিল। কিন্তু একটি বিষয় আমরা বুঝতে পারি যে, যে লোকটির অন্যের সাহায্য দরকার ছিল। অন্যের সাহায্য ছাড়া সে কিছুই করতে পারত না। হয়তো লোকটি যীশুর কথা শুনেছিল— তাঁর আশ্চর্য কাজের কথা শুনেছিল, হয়তো তারই পার্শ্ববর্তী কোন লোক ইতিমধ্যেই তার কাছে এসে সুস্থ হয়ে গেছে। হয়তো এরকম কোন কথা তার এই চার বন্ধুর কোন এক বন্ধু যীশুর কথা শুনেছিল। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যেকোন মূল্যে এই আশ্চর্য ডাক্তারের কাছে তার বন্ধুকে নিতেই হবে। তাকে সুস্থ্য দেখতে চাইলে তাঁর কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।
তারা চার বন্ধু মিলে রওয়ানা দিল কফরনাহুমের উদ্দেশ্যে। আমরা জানি না কয় দিন বা কতঘন্টা লেগেছিল যীশু যে বাড়ীতে আছেন সেখানে পৌঁছাতে। কিন্তু তারা যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছাল তখন দেখা গেল ঘর ভর্তি মানুষ। তারা যীশুর কথা শুনছে। আর সেখানে এত মানুষ যে, ঘর ছেড়ে বাইরে পর্যন্ত বিস্তর লোক বসে যীশুর কথা শুনছে। এই ভীড় ঠেলে যীশু অব্দি যাওয়া তাদের কাছে অসম্ভব মনে হল।
তারা যীশুর কাছে সেই রোগীকে পৌঁছে দেবার একটি বুদ্ধি বের করল। আমাদের কাছে সেই বুদ্ধিটা বেশ অদ্ভূত মনে হয়। আমাদের পেক্ষাপটে হয়তো তা সম্ভবও না। তারা সেই ঘরের ছাদে বা চালে উঠল। উদ্দেশ্য ছাদ বা চাল ফাঁকা করে সেখান দিয়ে তারা ঠিক যীশুর কাছে সেই রোগীকে নামিয়ে দেবে। তৎকালীন সমাজে যারা মধ্যবিত্ত তাদের ঘর সাধারণত টালি দিয়ে চাল বা ছাদ দেওয়া হত। বর্ণনা দেখে মনে হয় ঘরটি বেশ বড়ই ছিল। কিন্তু যদি আমি বা আপনি সেই বাড়ির মালিক হতাম তবে কি আমাদের ঘরের এত বড় একটা ক্ষতি হতে দিতাম? নিশ্চয়ই না। কারণ ঘর আমাদের আশ্রয়ের স্থান আর সেই স্থান আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না। তাও আবার অন্যের কারণে। কিন্তু এখানে আমরা ঘরের মালিকের কোন কিছু দেখতে পাই না। তার থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি না জানি না। আমরা জানি না হয়তো সেই ঘরের ভিড়ের মধ্যেই সে বসেছিল। ঘর থেকে বের হয়ে আসবার কোন সুযোগই হয়তো তার হাতে ছিল না। আর ইতিমধ্যেই এই অবশরোগীর চার বন্ধু তাদের পরিকল্পনা মাফিক ঘরের চাল সরাতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু আমার ভাবতে আশ্চর্য লাগছে যে, একটা ঘরের ছাদ খুলে ফেলছে আর তারই নীচে বসে লোকেরা যীশুর কথা শুনছে। এটা কি সম্ভব? আমার মাথার উপরে যদি এমন কিছু ঘটে তবে আমরা কি সেখানে বসে থাকতে পারব? আমরা কি চেঁচিয়ে উঠব না? আমাদের মাথার উপর কিছু না কিছু উপর থেকে পরে মাথা ফেটে যেতে পারে এই ভয়ে সেখান থেকে সরে যাব না? নাকি অন্য কোন কিছু এখানে কাজ করেছিল?
আমার কাছে মনে হয়, ছাদ খোলাখুলির কাজ যখন চলছিল তখন যীশু শ্রোতার মনে এমন এক গভীর মনমুগ্ধকর অবস্থা সৃষ্টি করেছিলেন যে, কেউ হয়তো টেরই পান নি যে, তাদের মাথার উপরকার ছাদ ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। সেই দিকে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপই ছিল না। মালিকও হয়তো টের পান নি যে, তার ঘরের ছাদ এতটাই খুলে ফেলা হয়েছে যেখান দিয়ে একটি খাট নামিয়ে দেওয়া যায়। তারা যীশুর কথা শুনতে শুনতে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, জগৎ-সংসারে আর কি হচ্ছে সেই দিকে তাদের কোন ভাবনার সৃষ্টি হয় নি। সত্যিকার অর্থেই যীশু এমন মুগ্ধ শ্রোতাই চান। আর এরকম মুগ্ধ শ্রোতা থাকলে পরে সেখানে ঈশ্বর গৌরবান্বিত হন। সেখানে আশ্চর্য কাজ হয় যা দেখে ভক্তশ্রোতারা ঈশ্বরের প্রশংসায় মুখরিত হয়ে উঠেন।
সেই চার বন্ধু চালের সেই ফাঁকা অংশ দিয়ে অবশ-রোগীটিকে নামিয়ে দিলেন ঠিক যেখানে যীশু আছেন তাঁর সামনে। যীশু নিজেও অবাক হয়েছেন— হতবাক হয়েছেন। তিনি অবাক হয়েছেন তাদের বিশ্বাস দেখে। তিনি অবাক হয়েছেন প্রয়োজনের সময়ে তার বন্ধুদেও হাত বাড়িয়ে দেওয়া দেখে। তিনি তাদের বিশ্বাসকে অবিশ্বাসে বদলে যেতে দেন নি। শাস্ত্র বলে, “তাহাদের বিশ্বাস দেখিয়া যীশু সেই পক্ষাঘাতগ্রস্তকে কহিলেন, বৎস তোমার পাপ সকল ক্ষমা হইল।”
আমরা জানি না যীশু সেই মুহূতে কি বিষয় নিয়ে লোকদের কাছে কথা বলছিলেন— কি বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছিলেন। আমরা জানি না কেনই বা লোকেরা মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে বসে তাঁর শিক্ষা শুনছিলেন। ষ্পষ্টতই দেখা যায় যে, সেই সময়টাতে তিনি কোন আশ্চর্য কাজ করছিলেন না কিন্তু লোকদের কাছে কথা বলছিলেন আর লোকেরাও তাঁর কথা শুনছিলেন। কিন্তু লোকদের কাছে একটা সুযোগ এলো একটি আশ্চর্য কাজ দেখার। যীশু এই সুযোগটিকে হাতছাড়া করেন নি। কারণ তিনি যে শিক্ষা দিচ্ছিলেন এই আশ্চর্যকাজ সেই শিক্ষাকে আরো প্রামানিক করে তুলবে— আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করুন যে, লোকেরা এই লোকটিকে তার পাপের ক্ষমা পাবার জন্য এখানে আনেন নি। পুরো দৃশ্যপট দেখলেই বুঝা যায় যে, তারা এসেছেন লোকটির সুস্থতার জন্য। লোকদের আশাও সৃষ্টি হয়েছে যে, যীশু এমন কিছু করবেন যাতে লোকটি সুস্থ হয়ে যায়। চালের উপর থেকেও তার বন্ধুরা অধীর আগ্রহে নীচের দিকে চেয়ে আছে কখন সে সুস্থ হবে। কিন্তু যীশু তাকে বললেন, “বৎস তোমার পাপ ক্ষমা হল।”
একটু চিন্তার বিষয় হল কেন যীশু তাকে সরাসরি সুস্থ না করে এমন একটি কথা বললেন যে, শ্রোতারা যারা এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনছিলেন তাদের মধ্যে কারো কারো মনে রিএকশন শুরু হল। তারা এটাকে সহজভাবে নিতে পারেন নি। তারা ভাবছে এ কে যে পাপ ক্ষমা করে?
আমরা মানুষ হিসাবে সব সময় আমাদের চোখে যে সমস্যা দেখা যায় আমরা সেটাকেই বড় করে দেখি। আমরা এর রুট কজস্ দেখতে চাই না। আমরা বাইরেরটা দেখেই বিচার করি। কিন্তু যীশু এখানে দেখাতে চেয়েছেন এর ভিতরের বিষয়টি— মূল সমস্যাটি— যেটির সমাধান আগে হওয়া উচিত। মূল সমস্যাটি সমাধান হয়ে গেলে যে সমস্যাটি চোখে দেখা যায় সেটি চলে যাবে। হয়তো সেজন্যই তিনি আগে এর পাপের সমস্যাটির সমাধান করতে চেয়েছেন। কারণ তিনি পাপীদের বন্ধু। আর একটি বিষয়ও তিনি লোকদের কাছে প্রকাশ কারতে চেয়েছেন যে, পাপ ক্ষমা করার ক্ষমতা তাঁর আছে। লোকদের এটা জানা দরকার যে, তিনিই মনুষ্যপুত্র যার আগমনের কথা লেখা আছে। তিনিই মশীহ যার মধ্যে সমস্ত ঈশ্বরত্ব বাস করে। তিনি লোকদের পাপ ক্ষমা করার অধিকার রাখেন।
পাপের সমস্যাটি দেখার পর তিনি মানুষের এক্সপেকটেশনের ব্যাপারে কাজ করেছেন। তিনি একটি প্রশ্ন করেছেন, “কোনটা সহজ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোককে ‘তোমার পাপ ক্ষমা হইল’ বলা, না ‘উঠ, তোমার শয্যা তুলিয়া বেড়াও’ বলা? এরপর তিনি সেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোককে বললেন, “তোমাকে বলিতেছি, উঠ, তোমার খাট তুলিয়া লইয়া তোমার ঘরে যাও।”
এর পর আমরা দেখতে পাই যে লোকটিকে ঘরে প্রবেশ করতে পারা যায় নি ভীড়ের কারণে সেই অসুস্থ লোকটি নিজের খাট বয়ে নিয়ে লোকদেও ভীড় ঠেলে ঈশ্বরের প্রশংসা করতে করতে বের হয়ে যেতে। তিনি ঘর থেকে বের হয়েই নিশ্চয়ই তার বন্ধুদের ডেকেছেন, নেমে আসতে বলেছেন— আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলেছেন, “দেখ আমি সুস্থ হয়ে গেছি। যীশু আমাকে ভাল করে দিয়েছেন। তোদের পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে। আমাদের আশা, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের প্রার্থনা ঈশ্বর শুনেছেন। ধন্য তাঁর নাম।”
উপসংহার:
বন্ধুত্বের কথা দিয়ে আজকের প্রচার-বাণী শুরু করেছিলাম। এই অবশ-রোগীকে যীশু সুস্থ করেছিলেন। কিন্তু এই বন্ধুরা যদি এই অসুস্থ লোকটিকে যীশুর কাছে না নিয়ে আসত তবে হয়তো এই ঘটনারই জন্ম হত না। এই ঘটনার মধ্যে যে শিক্ষার নতুন নতুন আলো আছে যা আমাদের চিন্তা, মন ও মমনকে আলোকিত করে তার জন্ম হত না। এসবই বন্ধুত্বের জন্য হয়েছিল। ঈশ্বর বন্ধুত্বকে মূল্য দেন। তিনি চান যেন আমাদের জীবনে ভাল বন্ধু থাকে— যেন আমরা ভাল ও উপকারী বন্ধু হই।
আমরা প্রকৃত বন্ধুত্ব শিখি আমাদের প্রভু যীশুর কাছ থেকে। তিনি আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। তিনি নিজেই আমাদের বন্ধু বলে ডেকেছেন। আমরা এই পৃথিবীর পাপী মানুষ হিসাবে এই উপকারী বন্ধুকেই আমাদের প্রয়োজন যিনি আমাদের পাপের জন্য দূরে সরিয়ে না দিয়ে কাছে ডেকে নেন। আমাদের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে তাঁর রাজ্যে স্থান দেন। তাঁর দরজা সব সময়েই আমাদের জন্য খোলা। তিনি তাঁর বন্ধুত্ব প্রমাণ করেছেন তাঁর রক্ত দিয়ে, কালভেরী ক্রুশে। তাঁর স্পর্শে আমরাও একজন আরেকজনের প্রকৃত বন্ধু হতে চাই। আমেন।
শাস্ত্র পাঠ: ১ পিতর ১:১-২ (কেরী ভার্সন)
“পিতর, যীশু খ্রীষ্টের প্রেরিত— পন্ত, গালাতিয়া, কাপ্পাদকিয়া, এশিয়া ও বিথুনিয়া দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যে প্রবাসীরা আছেন, যারা পিতা ঈশ্বরের পূর্বজ্ঞান অনুসারে মনোনীত এবং যীশু খ্রীষ্টের বাধ্য ও তাঁর রক্তে সিঞ্চিত হওয়ার জন্য পবিত্র আত্মার দ্বারা শুচি, তাঁদের সমীপে।”
ভূমিকা:
আমরা জানি যে, আমি এবং আপনি পিতর নই, যিনি প্রভু যীশুর সঙ্গে সারে তিন বছর সময় কাটিয়ে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন। তিনি প্রভুকে ছুঁয়ে দেখেছেন, তাঁর সাথে ঘুমিয়েছেন, আহার করেছেন এবং তাঁর শিক্ষায় সমৃদ্ধ হয়েছেন। আমি এবং আপনি সেরকমটা নই। আমরা শাস্ত্রের মধ্য দিয়ে তাঁদের কথা শুনছি ও শিক্ষা লাভ করে সমৃদ্ধ হচ্ছি। আমরা আজ পিতরের লেখা পত্রটির মাত্র দুটি পদ পাঠ করেছি। তিনি আমাদের কাছে যে বার্তা দিয়েছেন তা বোঝবার চেষ্টা করছি। আশা করছি যারা আজকের প্রচার-বাণী পাঠ করছেন আপনারা আমার সঙ্গে আছেন।
ধরুন, আপনি কষ্টে থাকা মানুষদের জন্য লিখছেন, তাহলে আপনি কি লিখতেন? সম্ভবত আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই সান্ত্বনা, উৎসাহ এবং আশার কতগুলো শব্দ দিয়ে বাক্য সাজিয়ে লিখবো। কারণ আমাদের উদ্দেশ্য হল যারা আমার পাঠক তারা যেন সান্ত্বনা পায়। আমরা যখন পিতরের চিঠি পাঠ করি, অবশ্যই সেই শব্দগুলো এই চিঠিতে পাই। কিন্তু বাস্তবে, পিতরের কথাগুলো মনে হয় খুবই আশ্চর্যজনক। প্রথমত: আমরা হতবাক হই, কারণ এই পত্রটি পিতর লিখেছেন যিনি তাঁর প্রভুকে অস্বীকার করেছিলেন, যখন প্রভু সঙ্কটে ছিলেন। কিন্তু আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি যীশু খ্রীষ্টের এই প্রেরিত যখন নির্যাতিত লোকদের কাছে চিঠি লিখেছেন সেই চিঠিটি সুখবরে পরিপূর্ণ। আমরা সবাই জানি পঞ্চাশত্তমীর দিনে পবিত্র আত্মা মণ্ডলীতে নেমে আসার পর, যীশু খ্রীষ্টের যে ‘রূপান্তরিত শক্তি’ মণ্ডলীকে দান করেছিলেন পিতর নিজেই ছিলেন সেই শক্তির পক্ষে একটি শক্তিশালী সাক্ষ্য। আমরা সত্যিই এই চিঠির প্রথম শব্দ ‘পিতর’ নিয়ে একটি বা একাধিক ধর্মোপদেশ প্রচার করতে পারি এবং ঈশ্বরের অনুগ্রহ নিজেই কী করতে সক্ষম তা পিতরের জীবন থেকে খুঁজে পেতে পারি।
পিতরের চিঠি থেকে যে কয়েকটি পদ আমরা পাঠ করেছি তার বিষয়বস্তু সত্যিই চমকপ্রদ। এটা সান্ত্বনার একটি স্তবের চেয়েও বেশী, অনেক বেশি। এটা সত্যিই ঈশ্বরের পক্ষে পরিচর্যা-কাজ করার আহ্বানের চেয়েও বেশী। এই শব্দগুলোতে খ্রীষ্টান জীবনে অগ্রসর হবার অনেক আহ্বান রয়েছে। এগুলো খ্রীষ্টীয় জীবনে লড়াই করার শব্দ যা পিতর লিখেছেন। হয়তো যারা কষ্ট পাচ্ছেন, নির্যাতিত হচ্ছেন তারা এটাই শুনতে চান।
আমরা যে দেশে বাস করি আর যেসব কারণে এখানে কষ্ট পাই সেটা কি? আমরা যখন হতাশ হই, যখন আমরা নিরুৎসাহিত হই, আমরা যখন আঘাত পাই, আমরা যখন ভয় পাই, আমরা যখন অসুস্থ হই, তখন আমাদের সামনে কী প্রলোভন থাকে? সেই প্রলোভন হল ভিতরের দিকে ফিরে যাওয়া; প্রলোভনগুলো খুব আত্মকেন্দ্রিক এবং খুব আত্ম-আবিষ্ট, খুব আত্ম-সচেতন হয়ে থাকে। যখন প্রলোভন আমাদের জীবনে থাকে, তখন আমরা নিজের মধ্যেই কষ্ট ভোগ করি? তখন আমাদের নিজেদের কষ্টের মধ্যেই আমরা সত্যিই ভাল থাকতে চাই। আর তাই পিতর আমাদের এমন কিছু বলেন যার মধ্যে বিস্ময়কর যাজকীয় জ্ঞান প্রকাশ পায়।
তিনি তাঁর উপদেশের মধ্য দিয়ে কষ্ট পাওয়া লোকদের তাদের কষ্টের দেয়াল ছাড়িয়ে অন্য পারে নিয়ে যান। তিনি তাদের এমন কিছুর একটি দর্শন দেন যেখানে তারা দেখতে পান যে, তারা যে কষ্টগুলো মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তার নিজেরা সেই কষ্টের চেয়েও অনেক বড় কিছু। প্রভু যীশু খ্রীষ্টের অনুগ্রহে তারা এখন কোথায় আছেন তা বিবেচনা করার জন্য তিনি তাদের আহ্বান জানান। আক্ষরিক অর্থেই তিনি তাদের একটি দর্শন দেন, যেখানে রয়েছে তাদের জীবনের প্রতিটি দিকের জন্য একটি আহ্বান। আর তাতেই আছে আশা আর স্বস্তি।
আমরা কি সঠিক বিষয়টি বুঝতে পেরেছি? তিনি যেন আমাদের বলছেন, “ওঠো, ঈশ্বর তোমাকে যা করতে বলেছেন তা করা। এখনও আমাদের তাঁর প্রয়োজন আছে, এবং ঈশ্বর এখনও তাঁর সিংহাসনে আছেন।” এটাই আমাদের কাছে পিতরের বার্তা। দেখুন পিতর কি লিখেছেন, তিনি আমাদের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করেছেন: এই ভাবে—
১. আমরা ‘ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী’
পিতর এই প্রথম পদে এমন কিছু লিখেছেন যা এই চিঠিটি জুড়ে তা একটি থিম বা মূলভাব হিসাবে কাজ করছে। তিনি বারবার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন আমরা কারা। কষ্ট মানুষ মাঝে মাঝে ভুলে যায়। কখনও কখনও আমাদের ব্যথা, আমরা যা কিছুর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা এত বড় হয় যে, এটি আমাদের মধ্যে স্মৃতিভ্রষ্টতা বা ‘আইডেন্টিটি অ্যামনেসিয়া’ তৈরি করে— আমরা তখন ভুলে যাই যে, আমরা কে। তাই পিতর এই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, আমরা যখন নিপীড়নের মুখোমুখি হই— নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যাই, তখনও আমরা ঈশ্বরের সন্তান। আর প্রেরিত যোহনও তাঁর চিঠিতে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, আমরা এই পৃথিবীর লোক নই। পিতরের এই চিঠিটি যাদের উদ্দেশ্যে লেখা তারা যখন এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তখন তাদের অবস্থান ছিল এশিয়া মাইনরে, বিশেষ করে বর্তমান তুরস্ক দেশে। আর এই মণ্ডলীগুলো ছিল অযিহূদী এবং যিহূদী মণ্ডলীর একটি মিশ্র দল, যারা নিপীড়নের শিকার হয়েছিল— যে নিপীড়ন আজও আমাদের মণ্ডলীগুলোর উপর নেমে আসে।
আসলে প্রকৃত নিরাপত্তা কোথায় পাওয়া যায়? আমরা আজ সেই অভ্যন্তরীণ কল্যাণের অনুভূতি কোথায় খুঁজব? আমার চারপাশের অবস্থাগুলো স্থিতিশীল না হলে তবে কী স্থিতিশীলতা প্রদান করে? আপনি যদি এখন সেই পরিস্থিতিতে না থাকেন তবে হয়তো আপনি সেই রকম অবস্থায় পড়তে পারেন। হতে পারে এটি একটি চাকরি হারানো, হতে পারে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার অর্থের ক্ষতি, হতে পারে এটি একটি শারীরিক অসুস্থতা, হতে পারে এটি আর্থিক অসুবিধা, হতে পারে এটি এক বন্ধুর সাথে লড়াই, অথবা ধর্মান্ধদের মারাত্মক আক্রমণ।
তখন হতে পারে কোনো না কোনোভাবে, আপনার পৃথিবী বিশৃঙ্খল মনে হবে। তখন কোথায় স্থিতিশীলতা খুঁজবেন? আপনি কি নিরাপত্তা সম্পর্কে ভাবছেন? আসলে নিরাপত্তা কোথায় পাওয়া যায়? আমি বিশ্বাস করি, নিরাপত্তা কেবলমাত্র এক জায়গায় পাওয়া যায়— পরিত্রাতার সঙ্গে আপনার সম্পর্কের মধ্যে। এখানে শব্দগুলো লক্ষ্য করুন: “ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যে প্রবাসীরা আছেন, যারা পিতা ঈশ্বরের পূর্বজ্ঞান অনুসারে মনোনীত।” এক সময় তারা যিরূশালেমে ছিল কিন্তু তাদের মণ্ডলী ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এখন শুধু জেরুশালেমেই নয়, সেই ‘প্রবাসীরা, যারা মনোনীত’ শব্দগুলো আসলে তাদের অবস্থানের চেয়েও বেশি কিছু বোঝায়। এটা সত্যিই পরিচয় বহনকারী একটি শব্দ।
এটি বলার আরেকটি উপায় হতে পারে— “আপনি কি বোঝেন না আপনি মনোনীত প্রবাসী?” আপনার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে কিনা আমি জানি না; আমি জানি না আপনি এই বিষয়ে চিন্তা করেছেন কি না, কিন্তু আপনি যদি ঈশ্বরের সন্তান হন, তাহলে আপনাকে মিশ্র-সাংস্কৃতিক জীবন-যাপনের জন্য ডাকা হয়েছে। এই পৃথিবী আমাদের জন্য আরামদায়ক কোন জায়গা নয় যেটা এক সময় ছিল, কারণ এখন আমাদেরকে আমাদের প্রভু আলাদা নিয়মের মাধ্যমে পরিচালনা করার জন্য ডেকেছেন। আমাদের হৃদয় একটি ভিন্ন রকমের অনুপ্রেরণা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে। আমরা এখন অন্য রাজার সেবা করছি। আমাদেরকে অন্য রাজ্যের নাগরিক হিসাবে স্বাগত জানানো হয়েছে।
আপনাদের সেই অভিজ্ঞতাগুলো থাকবে যেখানে মনে হচ্ছে আপনি মানানসই না, কারণ আপনি একটি ভিন্ন মান, একটি ভিন্ন নিয়মের সেটে থেকে কাজ করছেন। এই ব্যাপারটি নিয়ে একটু চিন্তা করুন। আপনি ‘এই জগতের নন’ এই আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য বেছে আপনাকে নেওয়া হয়েছে। আপনি আর এই জগতের উপযুক্ত নন বলে সম্মানিত হয়েছেন। আপনাকে একটু অদ্ভুত হতে আশীর্বাদ করা হয়েছে। আপনাকে সবাই ভুল বুঝবে— এই অনুগ্রহ করা হয়েছে। আপনাকে এমন কিছু করার জন্য মনোনীত করা হয়েছে যেগুলো স্বাভাবিক উপায়ে পৃথিবী পরিচালনা করে না। আপনার কাছে পৃথিবীর স্বাভাবিক পরিচালনার কোন মানে নেই কারণ আপনাকে ঈশ্বরের রাজ্যে স্বাগত জানানো হয়েছে। এই জন্য আপনাকে এই বিষয়টি নিয়ে শোক করা উচিত নয়; আপনার এটা লুকানো উচিত নয়। আপনি নিজেও হয়তো আর চাইবেন না যে, আপনি এই জগতের জন্য আরো ফিট হবেন, কারণ আপনি জানেন যে, আপনি এই জগতের নন, আপনি এখন প্রবাসী।
আমাদের এই প্রবাসী জীবনে এই সত্যটি নিশ্চিত করা হয়েছে যে, আমাদেরকে অনুগ্রহ, অর্থাৎ রূপান্তরকারী শক্তির অনুগ্রহ দেওয়া হয়েছে। এটি একটি বিস্ময়কর বিষয় যে,
এ সবই হল অনুগ্রহ, প্রভু যীশু খ্রীষ্টের অনুগ্রহ! এটা স্বর্গ-রাজ্যের অনুগ্রহ! কিন্তু আমরা যখন পিতরের লেখা চিঠি পাঠ করি তখন দেখতে পাই এটা একটি ‘অস্বস্তিকর অনুগ্রহ’; কারণ আমরা এখানে ‘প্রবাসী’ বা ‘বিদেশী’ বা ‘এই জগতের নই’। এটা আমাদের জন্য খুব সহজ ব্যাপার নয়, তবে এটি আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টের অনুগ্রহ।
২. আমরা ‘পিতা ঈশ্বরের পূর্বজ্ঞান অনুসারে মনোনীত’
পিতর বলেছেন এটা “… পিতা ঈশ্বরের পূর্বজ্ঞান অনুসারে” হয়েছে।
নিজেকে নিয়ে আপনি এইভাবে চিন্তা করুন, পৃথিবীর ভিত্তি স্থাপনের আগে ঈশ্বর আপনার প্রতি তাঁর ভালবাসা দেখিয়েছিলেন। আপনার একজন পিতা আছেন যিনি আপনাকে জানেন, এবং আপনার সম্পর্কে সবকিছু জানেন। আপনার একজন পিতা আছেন যিনি আপনার জীবনের গল্পের প্রতিটি দিক লিখেছেন, কারণ আপনার গল্পের প্রতিটি দিক তাঁর করুণায় আচ্ছাদন করা আছে এবং তিনি আপনার মধ্যে যে কাজটি করতে চাইছেন তার চূড়ান্ত সমাপ্তির সাথে যুক্ত। আমি মনে করি, প্রায়শই, যখন আমরা ঈশ্বরের পূর্বজ্ঞান সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন আমরা কেবল আমাদের পরিত্রাণের কথা ভাবি। কিন্তু মনে রাখুন, যদি ঈশ্বরের কাজ প্রগতিশীল হয়ে থাকে এবং এটি আমার সমগ্র জীবনকে জুড়ে দেবার জন্য কাজ করে, তাহলে এমন কি আমার গৌরব ও সম্মানের জন্যও এটা কাজ করে। ঈশ্বরের পূর্বজ্ঞান, আমার পরিত্রাণের চেয়েও বড় কিছু। এটা তাঁর সন্তান হিসাবে আমার সমস্ত জীবনের ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত।
আমি যা কিছুর মুখোমুখি হই না কেন, তখন আমি নিজেকে বলতে পারি, “আমার পিতা এটা জানেন।” আমি যেখানেই আছি, আমার পিতা এই অবস্থানের কথা জানেন। আমার পিতা আমার পরিস্থিতির কথা জানেন; আমার পিতা আমার পরিবেশের কথা জানেন; আমার পিতা জানেন আমার সাথে কি ঘটছে, কারণ আমি যা আছি, যা কিছুর মুখোমুখি হয়েছি, তা তাঁর পুস্তকে লেখা হয়েছে। এই সম্পর্কে চিন্তা করুন: আপনি যদি ঈশ্বরের সন্তান হন, তবে আপনি কখনই আপনার পিতার জ্ঞানের বৃত্ত থেকে সরে যাবেন না। আপনার পিতা তা জানেন। যে বিষয়গুলো আপনার কাছে বিরক্তিকর, এবং যেগুলো আপনার কাছে রহস্যময়, এবং যেগুলো বোঝা কঠিন, এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য পূরণ করছেন।
আপনাকে জানতে হবে যে, আপনার পিতা সব কিছু জানেন, এই জন্য নয় যে, এটি অবিলম্বে আপনার জন্য জীবনকে অর্থবহ করে তুলবে, কিন্তু তা নাহলে জীবন অর্থপূর্ণ হবে না। কিন্তু সেই মুহূর্তগুলো যেখানে আপনি বুঝতে পারেন না, যেখানে তাঁর ভালবাসা উপলব্ধি করা কঠিন, যেখানে তাঁর উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন, এমন মুহূর্ত যেখানে মনে হয় খারাপ লোকেরা জয়ী হচ্ছে, তখন আপনি এই শব্দগুলোর মাধ্যমে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারেন, “আমার পিতা জানেন।” তিনি নিঃশ্বাস নেওয়ার অনেক আগেই আমার জীবনের গতিপথ ঠিক করে দিয়েছিলেন। তিনি জানেন! তিনি জানেন! তিনি জানেন! তিনি সব কিছু জানেন!
৩. আমরা ‘যীশু খ্রীষ্টের বাধ্য ও তাঁর রক্তে সিঞ্চিত’
আমাদেরকে শুধুমাত্র একটি মিশ্র-সাংস্কৃতিক জীবনযাপনের জন্যই ডাকা হয়নি, আমাদের কেবল একজন পিতাই নেই যিনি সব জানেন, শুধু আমাদের মধ্যে অনুগ্রহে ভরা রূপান্তরিত শক্তি কাজ করছে না— আমাদেরকে একটি আমূল নতুন জীবনযাপনের জন্য ডাকা হয়েছে। যেখানে ‘আমাদের ইচ্ছা’ আমাদেরকে আর শাসন করবে না, আমাদের ‘আবেগ’ দ্বারা আর আমরা শাসিত হবো না, আমাদের নিজের জীবনের উপর আমরা আর ‘প্রভুত্ব’ করবো না। আমাদের যা কিছু আছে সেই সমস্ত কিছু এবং আমরা যা কিছু করি তার সব কিছু প্রভু যীশুর প্রভুত্বের অধীনে সমর্পন করার জন্য আমাদেরকে আহ্বান করা হয়েছে। সেই আহ্বানটি হল আমাদেরকে দেওয়া তাঁর সর্বোচ্চ সম্মান।
আমরা কখনই খ্রীষ্টের আনুগত্য স্বীকার করার জন্য ঈশ্বরের আহ্বান বুঝতে পারবো না যতক্ষণ না আমরা বুঝতে পারবো যে, আনুগত্য নিজেই একটি পুরস্কার। যে আমি ঈশ্বরের সন্তানদের একজন, যে আমাকে ডাকা হয়েছে, খ্রীষ্ট পৃথিবীতে যা করছেন তার অংশ হতে আমাকে মনোনীত করা হয়েছে, যে আমি আমার কর্মসূচী, আমার পথ, আমার স্ব-সার্বভৌমত্বের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়েছি— তা নিজেই একটি অনুগ্রহ। আমরা কি আমাদের নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করতে পারি: আমরা যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করি এবং যা কিছু বেছে নেই তা আমাদেরকে কীভাবে অনুপ্রাণিত করে? তাতে কি যীশু খ্রীষ্টের প্রভুত্ব আছে, তাঁর বাক্যের স্পষ্ট আহ্বান আছে? এবং আমরা কি বিশেষ অধিকারের অনুভূতি নিয়ে তা করি? এই পদটির মধ্যে দেখা যায়, “… তাঁর রক্তে সিঞ্চিত হওয়ার জন্য” আমাদের আহ্বান করা হয়েছে। এই সিঞ্চিত হওয়ার মধ্যে ধৌত করার এবং ক্ষমার একটি প্রতিচ্ছবি রয়েছে, যা পুরাতন নিয়মের সময়ে করা হতো।
যীশু খ্রীষ্টের রক্ত সিঞ্চনের মাধ্যমে, আমরা ধার্মিক হিসাবে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াই। তবুও পাপের উপস্থিতির কারণে, আমরা এমন লোক হয়েছি যাদের প্রতিদিনের জন্য ক্ষমার প্রয়োজন এবং প্রতিদিন পরিষ্কারের প্রয়োজন। এটা কি আমাদের জন্য একটি চমৎকার আশা নয় কি? আমাদের সংগ্রাম যতই গভীর হোক না কেন, আমাদের ব্যর্থতা যতই বড় হোক না কেন, আমাদের দুর্বলতা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তারপরেও অব্যাহত ক্ষমা আছে, এবং চলমান শুচিতা আছে, তাই ঈশ্বরের উপস্থিতি থেকে আমাদেরকে ভয়ে দৌড়ে পালাতে হবে না। খ্রীষ্টের রক্ত ঢালনের কারণে, আমি তাঁর দিকে দৌড়াতে পারি এবং তাঁর কাছ থেকে দূরে না গিয়ে আবার তাঁর ক্ষমা পেতে পারি এবং আবার তাঁর শুচিতা লাভ করতে পারি। আপনি কি দৌড়াচ্ছেন? আপনি কি অপরাধবোধে লুকিয়ে আছেন? আপনি কি লজ্জায় গা ঢাকা দিচ্ছেন? আপনি কি ক্ষমা এবং মুক্তির একমাত্র জায়গা থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন? এই পরিচয় সম্পর্কে চিন্তা করুন: আমাকে ঈশ্বরের রাজ্যের কাজের অংশ হতে মনোনীত করেছেন, যা এই বিশ্বের নয়। আমি একজন পিতার পুত্র বা কন্যা যিনি জানেন কারণ তিনি আমার গল্প লিখেছেন। আমি তাঁর রূপান্তরিত শক্তির করুণার বস্তু, এবং সেই কাজটি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি পিছপা হবেন না। আমি যেন প্রতিদিন তাঁর মত হয়ে উঠতে পারি সেই জন্য তিনি কাজ করে চলেছেন।
খ্রীষ্টের উপর বিশ্বাস ও তাঁকে আমার জীবনে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে আমি আমার নিজের জীবনের ছোট সীমানার চেয়ে বড় কিছুর অংশ হওয়াটা বেছে নিয়েছি। আমি যা কিছু এবং আমার যা কিছু আছে তা যীশু খ্রীষ্টের প্রভুত্বের কাছে সমর্পণ করেছি। আমি ক্রমাগত ক্ষমা এবং দৈনিক শুদ্ধকরণের দ্বারা আশীর্বাদ পাচ্ছি।
আপনারা যারা আজ এই প্রচার-বাণী শুনছেন বা পড়ছেন তাদের আমি জিজ্ঞাসা করছি, “আপনি কি এই বিশ্বাসের মতো জীবন-যাপন করছেন? এভাবে বেঁচে থাকাটা কি আসলেই আপনার পরিচয়? নাকি যেভাবে আপনাকে আঘাত করা হয়েছে সেভাবে আপনি তাকে আঘাত করতে চান? প্রভুতে আপনার যে পরিচয় আপনি কি সেই পরিচয়টি ধরে রাখেন যখন বিনা কারণে আপনি আপনার চাকরি হারিয়েছেন, এবং আপনি জানেন না কিভাবে আপনি আপনার বিল পরিশোধ করতে যাচ্ছেন, এবং আপনি ভাবছেন পৃথিবীতে ঈশ্বর কি করছেন? আপনি যখন আপনার সন্তানের দৃঢ় ইচ্ছার মুখোমুখি হন, তখন কি আপনি একজন পিতামাতা হিসাবে এই পরিচয়টি ধরে রাখতে পারেন যে, আপনি একজন মনোনীত? আপনি কি এই পরিচয়টি ধরে রাখেন যখন আপনি কর্মক্ষেত্রে একা বোধ করেন কারণ লোকেরা সেখানে যে জিনিসগুলো ভাগ করে নেয়, আপনি সম্ভবত ঈশ্বরের সন্তান হিসাবে সেই ভাগ নিতে পারেন না? আপনি ঈশ্বরের সন্তান এই পরিচয় কি আপনাকে বিশ্রাম দেয় যখন আপনি ঘুমাতে যান?
“আমার পিতা জানেন যে, তাঁর রূপান্তরিত করুণার শক্তি আমার জীবনে রয়েছে। যতক্ষণ না তিনি তাঁর কাজ শেষ করছেন ততক্ষণ তিনি পিছপা হবেন না। আমি দৈনিক ক্ষমা এবং শুচিকরণ দ্বারা আশীর্বাদ পেয়েছি। যদিও আমার পৃথিবী এলোমেলো যেতে পারে, কিন্তু আমার নিরাপত্তা আছে, কারণ আমি ঈশ্বরের সন্তান।”
৪. আমরা ‘পবিত্র আত্মার দ্বারা শুচিকৃত’
আমাদের ‘মনোনীত হওয়ার’ জীবনে পাপের শক্তি ভেংগে গেছে, কিন্তু পাপের উপস্থিতি এখনও রয়ে গেছে। আমরা হয়তো এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা আমাদের কথায়, সিদ্ধান্তে, চিন্তা-ভাবনায়, আকাঙ্ক্ষায়, সংগ্রামে আমরা যে দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলাম তার মধ্য দিয়ে আমরা প্রমাণ দিয়েছি যে, পাপের উপস্থিতি এখনও আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে। হয়তো ব্যক্তিগত মুহূর্তে, হয়তো প্রকাশ্য মুহূর্তে, আমরা দেখিয়েছি যে, আমাদের মধ্যে এখনও পাপ অবশিষ্ট রয়েছে।
তাহলে আমাদের পরিচয় কি? একজন যিনি কেবল নিজে পাপের সাথে লড়াই করেন এবং কোন না কোনভাবে, আমরা আশা করি যে, আমরা এটিকে পরাজিত করতে পারবো? আসলে তা না। আমরা যদি ঈশ্বরের সন্তান হয়ে থাকি, আমাদের ত্রাণকর্তা তাঁর আত্মার উপস্থিতিতে আমাদের কাছে এসে থাকেন, এবং যদি তিনি আমাদের ভিতরে বাস করেন, তবে দেখুন পৌল গালাতীয় ৫ অধ্যায়ে বলেছেন যে, আত্মা আমাদের পাপ-স্বভাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এর মানে আমারা একজন যোদ্ধা— আত্মা আমাদের পক্ষে যুদ্ধ করছেন যেন আমরা পাপ থেকে উঠে আসতে পারি। আমরা শুধু এমন একজন ব্যক্তি নই, যিনি পাপের সাথে লড়াই করছেন, আত্মাও আমাদের সঙ্গে লড়াই করছেন।
আমরা যদি ঈশ্বরের সন্তান হয়ে থাকি, তাহলে তাঁর অনুগ্রহে আমরা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছি। যিনি অনুগ্রহ করছেন তিনি তাঁর কাজ থেকে ফিরে আসবেন না যতক্ষণ না সেই কাজটি সম্পন্ন হয়, যতক্ষণ না আমরা সম্পূর্ণরূপে প্রভু যীশু খ্রীষ্টের প্রতিমূর্তিতে রূপান্তরিত না হই। আমরা কি জানি এর মানে কি? এটা ঠিক স্বামী এবং স্ত্রীর মিলনের মত— এর অর্থ হল আমাদের প্রভুর সঙ্গে আমাদের মিলনের আশা আছে কারণ ঈশ্বরের আত্মার রূপান্তরকারী শক্তি আমাদের পক্ষে কাজ করছে। ঈশ্বরের সঙ্গে একটা কঠিন বন্ধুত্বের আশা আমাদের আছে। পাপকে পরাজিত করার চিন্তা এবং আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে আছে আর সেজন্য আমরা সংগ্রাম করছি। আমরা যদি পাপকে পরাজিত করতে অক্ষম হই, তবে সেখানে পাপের জন্য আশা আছে। কিন্তু মনে রাখুন, এই যুদ্ধে আমরা একা নই! ঈশ্বর আমাদের কাছে এসেছেন, এবং তিনি আমাদের ভিতরে বাস করেন। তিনি আমাদের পক্ষে যুদ্ধ করেন, এবং তাঁর অনুগ্রহে আমাদেরকে রূপান্তরিত করেন।
আমি আজ আপনাকে বলতে চাই যে, আপনার এখন একটা পরিচয় আছে। আপনি একজন স্মৃতিহারা ব্যক্তি তা তো হতে পারে না! আপনি কে তা আপনি কখনও ভুলবেন না! আপনি এমন জায়গায় নিরাপত্তা খুঁজবেন না যেখানে এটি খুঁজে পাওয়া যায় না। আপনাকে যে অনুগ্রহ দেওয়া হয়েছে আপনি তাতেই নির্ভর করুন। যে অনুগ্রহ আপনাকে দেওয়া হয়েছে তা নিজেই তার কাজ সম্পূর্ণ করবে। এই অনুগ্রহই আপনাকে সত্যিকারের শান্তি দিতে পারে।
হয়তো আপনারা যারা এই প্রচারবাণীটি শুনছেন বা অনলাইনে পাঠ করছেন তারা হয়তো বলছেন, “আমি মনে করি না এটা আমার পরিচয়। আমি মনে করি না যে, আমি সেই জন যার বিষয়ে আপনি লিখছেন।”
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমি আপনাকে স্বাগত জানাব, এই মুহূর্তে, আপনি যেখোনেই থাকুন না কেন আপনি যদি আপনার অনন্তকালীন পরিচয়ে পরিচিত হতে চান— আপনি যদি খ্রীষ্টের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান তবে খ্রীষ্টের দিকে ফিরুন। সেই অনুগ্রহের জন্য প্রার্থনা করুন যে অনুগ্রহ আপনাকে দেবার জন্য প্রভু যীশু খ্রীষ্ট ক্রুশে স্বেচ্ছায় নিজের রক্তের বিনিময়ে আপনাকে ক্রয় করে নিয়েছেন।
আসুন প্রার্থনা করি: “প্রভু, সাধু পিতরের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে এই কথা বলার জন্য ধন্যবাদ দিই। আমি বিশ্বাস করি এই চিঠি আমাদের কাছেই লেখা হয়েছে। আমরা একটি পতিত বিশ্বের বাসিন্দা, আমরা এখানে নানাভাবে কষ্ট পাচ্ছি। এখানে এমন কিছু হয় যখন আমরা প্রভু যীশু খ্রীষ্টের প্রতি আমাদের আনুগত্যের জন্য আমাদেরকে ভুল বোঝে, আমাদের উপহাস করে এবং আমরা নির্যাতিত হই। সেইরকম কোন মুহূর্তে আমরা হয়তো ভুলে যাই আমাদের সত্যিকারের পরিচয়। আমরা ভুলে যাই আমরা কে। আমরা যে তোমার সন্তান, সেই কথা ভুলে যাই।
কিন্তু হে প্রভু তোমাকে ধন্যবাদ দিই যে, আমাদের তোমার রাজ্যের নাগরিক করে নিয়েছ। আমাদের কোন ধার্মিকতার জন্য তা করো নি। কিন্তু সেই কারেণ, আমরা এই পৃথিবীতে এখন পরবাসী, বিদেশী হিসাবে আছি। তোমাকে ধন্যবাদ দিই যে, তুমি আমাদের জীবনের প্রতিটি বিবরণ জান, কারণ এটি তোমার বইতে লেখা হয়েছে। তোমাকে ধন্যবাদ দিই যে, আমরা চলমান, রূপান্তরিত ও তোমার করুণার অধীনে চলছি। তোমাকে ধন্যবাদ দিই যে, আমরা যারা এখনও পাপের সাথে সংগ্রাম করি, সেখানে প্রতিদিন তোমার কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করি এবং প্রতিদিন তুমি আমাদের শুচি করে আসছো। তোমাকে ধন্যবাদ দিই যে, তুমি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আমাদেরকে আরও বড় কিছু দিয়েছ, এবং তুমি আমাদেরকে বাধ্যতার সাথে তোমার প্রভুত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য আহ্বান করেছ। ধন্যবাদ প্রভু! তুমি আমাদের প্রতি তোমার করুণা ও অনুগ্রহ বার বার বৃদ্ধি করে যাচ্ছ। আমরা তোমার মধ্যে এখন বিশ্রাম করতে পারি। যীশুর নামে এই প্রার্থনা চাই, আমেন।”
শাস্ত্র পাঠ: যিশাইয় ৪০:৬—৮ “এক জনের রব, সে বলিতেছে, ‘ঘোষণা কর,’ এক জন কহিল, ‘কি ঘোষণা করিব?’ ‘মর্ত্যমাত্র তৃণস্বরূপ, তাহার সমস্ত কান্তি ক্ষেত্রস্থ পুষ্পের তুল্য। তৃণ শুষ্ক হইয়া যায়, পুষ্প ম্লান হইয়া পড়ে, কারণ তাহার উপরে সদাপ্রভুর নিশ্বাস বহে; সত্যই লোকেরা তৃণস্বরূপ। তৃণ শুষ্ক হইয়া যায়, পুষ্প ম্লান হইয়া পড়ে, কিন্তু আমাদের ঈশ্বরের বাক্য চিরকাল থাকিবে।’”
১. ভূমিকা
সব কিছুরই এক শেষ সীমা আছে। যা কিছু সৃষ্টি হয় তা একদিন না একদিন শেষ হয়। এই ক্ষয় বা লয় প্রাপ্ত হওয়া শুধু মাত্র আমাদের গ্রহে নয় এমন কি আমাদের গ্রহের বাইরেও এই সত্য প্রতিষ্ঠিত। বিজ্ঞাণীরা বলেন, আমাদের পাশের মঙ্গল গ্রহ নাকি একদিন আমাদের গ্রহের মতই সজীব ও প্রাণময় ছিল কিন্তু কালের আবর্তে তা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত— জীবনের কোন চিহ্ন সেখানে নেই। যে জেমস্ ওয়েব ক্যামেরা আজ মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার পাঠানো ছবি থেকে এই রকম ধ্বংসপ্রাপ্ত অনেক গ্রহ ও নক্ষত্রের সন্ধান মেলে আবার অনেক নক্ষত্র জন্ম হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে। এর মানে হল যাকিছু শুরু হচ্ছে তার শেষ আছে। যার জন্ম হয় তার মৃত্যুও ঘটে। কিন্তু আজ আমরা যে সত্য নিয়ে কথা বলছি তা হল ঈশ্বরের বাক্য। পবিত্র বাইবেল বলে ঈশ্বরের বাক্য চিরকাল থাকবে। তাই ঈশ্বরের বাক্যকে যখন আমরা আমাদের মন-প্রাণ ও অর্থ দিয়ে সম্মান করি তখন ঈশ্বরকেই সম্মান করা হয়।
২. জীবনে প্রতিদিনই ঈশ্বরের বাক্যকে সম্মান করা উচিত
এই পৃথিবীতে নানা রকম দিন পালিত হয়ে আসছে। যুগের পর যুগ ধরেই আমরা তা পালন করছি। ধমীর্য় দিনগুলোতে নানা ধর্মের লোকেরা তাদের ধর্মের রীতিনীতি অনুসারে তা পালন করে থাকে। জাতিসংঘ অনেক দিবস সৃষ্টি করে যেন যে বিষয়ের উপর জোর দিয়ে দিবস সৃষ্টি করা হয় যেন জাতিসংঘ ভুক্ত দেশগুলো সেই বিশেষ বিষয়ের উপর নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং লোকদের সেই বিষয়ে সচেতন করে তোলে। সারা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকানরা কৃতজ্ঞতা বা ‘থ্যাঙ্ক গিভিংস ডে’ পালন করে আসছে। একদল ইউরোপিয়ান সাগর পারি দিয়ে আমেরিকাতে গিয়ে উঠেছিল। সেখানে অন্নবস্ত্রের অভাবে ও শীতে অনেকে মারা পরে। যারা বেঁচে ছিলেন তারা প্রথম বারের মত চাষবাস করে যে ফসল ঘরে তুলেছিল সেজন্য তারা নতজানু হয়ে ঈশ্বরের ধন্যবাদ প্রশংসা করে ঈশ্বরকে ফসলের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল। সেই থেকে ‘থ্যাঙ্ক গিভিংস ডে’ পালিত হয়ে আসছে আর এখন আমেরিকা সহ সারা ইউরোপে এটি একটি বড় দিবসে পরিণত হয়েছে। এই দিবসে তারা ঈশ্বরকে সম্মানিত করে তাঁর প্রশংসা করে— আমি বিশ্বাস করি আমেরিকার এই যে প্রথম জেনারেশন ঈশ্বরকে সম্মান দেখিয়েছিল— ঈশ্বর প্রতিউত্তরে তাদের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন তাদের জীবনে প্রস্পারিটি দিয়ে— তাদের জীবনে উন্নয়ন দিয়ে। ঈশ্বরকে যারা তাদেরে জীবন দিয়ে সম্মান করে ঈশ্বরও তাদের সম্মান করেন বহুগুণ দয়া ও অনুগ্রহ দান করে। পবিত্র বাইবেল এর সাক্ষী। আমাদের খ্রীষ্টীয় জীবনে ঈশ্বরকে সম্মান দিলে আমরাই বহুগুণে আশীর্বাদ প্রাপ্ত হই। পবিত্র শাস্ত্রে অনেক প্রমাণ আছে।
৩. ঈশ্বরকে সম্মানিত করলে ঈশ্বর তাঁর বিবিধ দয়া ও অনুগ্রহ অনুসারে আমাদের সম্মানিত করে থাকেন
পবিত্র বাইবেলের একটি উদাহরণ দিচ্ছি—প্রথম বংশাবলি ১৭ অধ্যায়:
দায়ূদ রাজা হবার পর তিনি ভাবলেন আমি রাজ বাড়িতে থাকছি আর সদাপ্রভুর সিন্দুক তাম্বুতে বাস করছে। তিনি সদাপ্রভুর জন্য এক মন্দির নির্মাণের স্বপ্ন দেখলেন। নবী নাথনকে ডেকে তিনি তাঁর আকাঙ্খার কথা জানালেন। তিনি জানালেন যে, তিনি সদাপ্রভুর জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করতে চান।
নবী নাথন বললেন আপনার মনে যা আছে আপনি তা ঈশ্বরের জন্য করুন। কারণ ঈশ্বর আপনার সংগে আছেন।
সেই দিন রাতেই দায়ূদের জন্য নবী নাথনে কাছে ঈশ্বরের বাক্য উপস্থিত হল।
৪. দায়ূদের এই ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা করার অনেক বিষয় আছে ঈশ্বরকে সম্মান করলে ঈশ্বর কি পরিমানে সম্মান ও উন্নতি আমাদের জীবনে ফিরিয়ে দেন
তখন ঈশ্বর এর প্রতিউত্তর দান করেন— তিনি তাঁর অসীম অনুগ্রহ থেকে এর বিনিময় দান করেন। আমরা যা দেই তিনি তার অনেকগুণ সম্মান, ধন-সম্পদ, সুস্থ্য জীবন, এবং আরো অনেক অনুগ্রহ দিয়ে ভরিয়ে দেন। ঈশ্বরের বাক্য তার প্রমান।
৫. আমাদের জীবনে সব সময়ই ঈশ্বরের জীবন্ত বাক্যকে সম্মান দেওয়া উচিত— তাঁর বাক্যে আমরা পাঠ করেছি:
‘মর্ত্যমাত্র তৃণস্বরূপ, … তৃণ শুষ্ক হইয়া যায়, পুষ্প ম্লান হইয়া পড়ে, কারণ তাহার উপরে সদাপ্রভুর নিশ্বাস বহে; সত্যই লোকেরা তৃণস্বরূপ। তৃণ শুষ্ক হইয়া যায়, পুষ্প ম্লান হইয়া পড়ে, কিন্তু আমাদের ঈশ্বরের বাক্য চিরকাল থাকিবে।’
এখানে মানব জাতির সংগে ঈশ্বরের বাক্যের একটি কনট্রাষ্ট দেখানো হয়েছে এবং মানুষের সংগে সমান্তরাল ভাবে ক্ষেত্রের পুষ্প ও তৃণের সংগে একটি সিমিলি দেখানো হয়েছে।
আমরা যুগে যুগে দেখেছি এই বাক্য চিরস্থায়ী। অনেক অপশক্তি যুগে যুগে এই বাইবেলকে ধ্বংস করে ফেলতে চেয়েছে। পৃথিবীর অনেক বড় বড় রাজা-বাদশারা এমন কি সম্রাটগণ পবিত্র বাইবেলকে ধ্বংস করতে চেয়েছে কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যারা ঈশ্বরের পবিত্র বাক্যকে ধ্বংস করতে চেয়েছে তারা জগত-সংসার থেকে ধ্বংস হয়ে গেছে।
আজকের শাস্ত্রপাঠে সেই ঈশ্বরের চিরস্থায়ী বাক্যের জয়গান করা হয়েছে। কারণ—
— এই বাক্য সত্য (২ শমূয়েল ৭:২৮)
— এই বাক্য ঈশ্বর নিশ্বঃসিত (২ তীম ৩:১৬)
— এই বাক্য মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে (মথি ৪:৪)
— এই বাক্য মানুষকে মৃত্যু থেকে জীবনে পার করে দেয় (যোহন ৫:২৪)
— এই বাক্য মানুষকে পরিত্রাণের জন্য জ্ঞান দান করে (২ তীম ৩:১৫)
— এই বাক্য অনন্ত জীবনের পথ দেখায় (১ যোহন ৫:৯—১২)
— এই বাক্যই মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন আর আমরা তাঁর মহিমা দেখেছি যীশু খ্রীষ্টের মধ্যে।
৬. ঈশ্বরের এই বাক্য আমাদের জীবনে থাকতে হবে কারণ এটা আমাদের জীবনের জন্যই প্রয়োজন কারণ তা জীবনের নানা বিষয়ের কথা বলে— অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথা আমাদের জ্ঞাত করে।
— কেমন করে আমরা আমাদের পাপের ক্ষমা পেতে পারি সেই কথা আমাদের জানিয়ে দেয়
— কেমন করে প্রেমময় ঈশ্বরের প্রেম আমরা লাভ করতে পারি সেই কথা আমাদের বলে দেয়
— এই অশান্তির জগতে কিভাবে শান্তি লাভ করতে পারি সেই পথ আমাদের দেখিয়ে দেয়
— এই নিরাশার পৃথিবীতে কিভাবে মানুষ আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে সেই পথ আমাদের দেখিয়ে দেয়
— এই অপবিত্র জীবন পথে কিভাবে আমরা ঈশ্বরের পবিত্রতা অর্জন করতে পারি বাইবেল সেই পথ আমাদের দেখিয়ে দেয়
— কিভাবে একটি স্বগীর্য় আনন্দময় জীবন যাপন করা যায় বাইবেল সেই পথ আমাদের দেখিয়ে দেয়।
৭. ঈশ্বরের এই পবিত্র শাস্ত্র আমাদের দিয়েছেন যেন আমরা আমাদের জীবন গঠন করতে পারি— গড়ে তুলতে পারি— জীবনকে নির্মাণ করতে পারি। ঈশ্বর তাঁর এই নিজের বাক্যকে ৮টি প্রতীক রুপে আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন:
বাক্যকে বলা হয়েছে: খড়গ, হাতুড়ি, বীজ, আয়না, অগ্নি, প্রদীপ, খাদ্য ও দুধ।
কেন ঈশ্বর তার বাক্যকে এইসব প্রতীকরুপে ব্যবহার করেছেন। আপনার জীবনে যেভাবে এর প্রয়োজন সেভাবেই এই বাক্য আপনার সামনে এসে দাড়ায়।
ঈশ্বরের বাক্য সত্যি এক অদ্ভূত এবং বিশ্বয়কর। আমাদের জীবনের এমন কোন দিক নেই যা এই বাক্য আলোচনা করে না।এমন কোন বিষয় নেই যে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয় না। ৪০ জন লোক ১৬০০ বছর ধরে এই বইয়ের পিছনে সময় দিয়েছেন।
৮. আমাদের পবিত্র বাইবেল সত্যিই একটি বিস্ময়— আমরা বলি সপ্তাচার্যের এক আশ্চর্য
ক. গঠন: বিভিন্ন বই বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন লোকে তবুও একটিই উদ্দেশ্য এর মধ্যে সংস্থাপিত হয়েছে।
খ. সংযোজন: ৬৬টি বইয়ের একটি লাইব্রেরী তথাপি যেন একজন এর লেখক— পবিত্র আত্মা
গ. বিক্রি: সবচেয়ে বেশী বিক্রি হচ্ছে— একে এখনও কোন বই অতিক্রম করে নি
ঘ. সময়: হাজার হাজার বছরের ব্যবধানে লেখা তবুও একটি ধারা এর মধ্যে সংরক্ষিত
ঙ. জনপ্রিয়তা: সকল স্তরের লোক এর পাঠক
চ. ভাষা: এত বেশী ভাষায় আর কোন বই অনুদিত হয় নি
ছ. সুরক্ষা: এত বেশী আক্রমণ আর কোন পুস্তকরে উপর হয় নি তবুও টিকে আছে সগৌরবে
আমি এই কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি সময়ের পরিক্রমায় এই পুস্তক চরিত হলেও জীবনের সব দিক, প্রয়োজনের সব দিক এতে আলোচিত হয়েছে যেন মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে জীবন ধারণ করতে পারে:
হ্যা, পবিত্র শাস্ত্র যদিও বিজ্ঞান নয়, দর্শন নয়, কবিতা নয়, গল্প নয়, ইতিহাস নয় কিন্তু এখানে যুগে যুগে ঈশ্বর মানুষের সংগে কিভাবে ব্যবহার করেছেন সেই কথাই যুগে যুগে লিখিত হয়েছে এবং তা পবিত্র শাস্ত্র রূপে আমাদের কাছে এসেছে— যেন আমরা জীবনের পথ বেছে নিতে পারি। আমরা খ্রীষ্টভক্ত হিসাবে— যখন আমরা জীবনের আধারকে ধারণ করি— তখন মৃত্যু নয় ধ্বংস নয় কিন্তু অন্যদের কাছে আমাদের জীবন নিয়েই হাজির হতে হবে। সেই জীবনের জন্যই আমরা প্রচার করি। এই বাক্য প্রচারের ফলে:
উপসংহার:
— ঈশ্বরের বাক্য আমাদের জীবনের মানদন্ড
— ঈশ্বরের বাক্য মুক্তিদাতার সংগে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়
— তাই বাইবেলের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়া— যারা এর উন্নয়ন, বিপনন, এর রিসার্চ এর যুক্ত তাদের জন্য প্রার্থনা করা
— এখনো অনেক জাতিগোষ্ঠি আছে যাদের মাতৃভাষায় ঈশ্বরের বাক্য নেই তারা যেন বাইবেল পেতে পারে এমন অনুবাদ প্রকল্পে সাহায্য করা ও দান দেওয়া
— সারা পৃথিবীতে সব বাইবেলে এজেন্সিগুলো কয়েক মিলিয়ন বাইবেল প্রতি বছর লোকদের হাতে পৌছাতে সমর্থ হয়।
আসুন সেজন্য এই বিশেষ দিনে আমাদের প্রার্থনা দিয়ে, আমাদের দান দিয়ে আমরা ঈশ্বরের বাক্যকে সম্মান করি— আমি বিশ্বাস করি আমাদের তাঁর বিবিধ অনুগ্রহ অনুসারে আমাদের সম্মান করার জন্য এগিয়ে আসবেন।
পবিত্র নতুন নিয়ম থেকে যোহন লিখিত সুসমাচারের প্রথম অধ্যায়ে প্রথম পদ বলে: প্রথমেই বাক্য ছিল, বাক্য ঈশ্বরের সঙ্গে ছিল, বাক্য নিজেই ঈশ্বর ছিল। হয়তো এটাই সেই মহাসত্য যার কারণে ঈশ্বরের বাক্য চিরকাল থাকবে।
শাস্ত্র পাঠ:
“সত্যি, আমাদের যাতনাগুলো তিনিই তুলে নিয়েছেন, আমাদের ব্যথাগুলো তিনি বহন করেছেন; তবু আমরা মনে করলাম, তিনি আহত, ঈশ্বরকতৃর্ক প্রহারিত ও দুঃখার্ত। কিন্তু তিনি আমাদের অধর্মের জন্য বিদ্ধ, আমাদের অপরাধের জন্য চূর্ণ হলেন; আমাদের শান্তিজনক শাস্তি তাঁর উপরে বর্তিল এবং তাঁর ক্ষতগুলো দ্বারা আমাদের আরোগ্য হল।” (যিশাইয় ৫৩:৪-৫ পদ, নিউ কেরী ভার্সন)
ভূমিকা:
বাঙ্গালী হিসাবে ফেব্রুয়ারী একটি বিশেষ মাস। আমরা সবাই জানি এটা আমাদের ভাষার মাস। এই মাসেই এক বুক রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের ভাষাকে চিরকালের জন্য মায়ের ভাষা হিসাবে পেয়েছি। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা তাদের তাজা প্রাণ দান করেছেন যেন আমরা মাকে ‘মা’ বলে ডাকতে পারি। আর ফেব্রুেয়ারীর একুশ হল সেই স্মরণীয় মুহূর্ত যখন দেশ-বিদেশে যেখানেই বাঙ্গালী থাকুক না কেন আমরা আমাদের শহীদদের ফুলের শ্রদ্ধায় তাদের স্মরণ করি। যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, আমাদের মাঠে যতদিন সবুজ থাকবে, আমাদের কৃষ্ণচুড়ায় যতদিন রক্ত রাঙ্গা ফুল ফুঠবে ততদিন আমরা তাদের কথা স্মরণ করতেই থাকব।
একুশ আমাদেরকে একটি সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়— একটি চরম সত্যকে মেনে নিতে আমাদের উদাত্ত আহ্বান করে। আর সেই সত্য হল কোন অর্জন— কোন বড় কিছুঅর্জন করতে হলে তার বিনিময়ে বড় কিছু দান করতে হয়। কিছু না দিলে কিছু পাওয়া যায় না।
একুশের হাত ধরে যে স্বাধীনতা আমাদের জীবনে যোগ হয়েছে, যার জন্য আমরা একটি স্বাধীন ভূ-খন্ড পেয়েছি তার বিনিময়েও আমাদের দিতে হয়েছে ত্রিশ লক্ষ জীবনের রক্ত। তবেই না আমরা পেয়েছি আমাদের এই ভূ-খণ্ড। তাইতো কবি লিখেছেন, “অনেক দাম দিয়ে কিনেছি …।”
আলোচনা:
আজকের আলোচনার জন্য যেখান থেকে শাস্ত্রাংশটুকু বেছে নিয়েছি তা সত্যি চমকপ্রদ ও প্রাসংগিক। ভাববাদী যিশাইয়কে আমরা একজন ভবিষৎ বক্তা হিসাবেই চিনি। তিনি তাঁর জীবনকালের সময়ের জন্য যত না কথা বলেছেন তার চেয়েও বেশী বলেছেন ভবিষ্যত সময়ের জন্য। বিশেষ করে সামনে যে নতুন নিয়মের যুগ আসছে সেই যীশু খ্রীষ্টের যুগও তাঁর জীবনের নানাবিধ বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আমরা জানি, তিনি যীশু খ্রীষ্টের জন্ম, তাঁর পরিচর্যা ও তাঁর মৃত্যুর কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন।
সদাপ্রভুর দত্ত পরিত্রাণের মহা পরিকল্পানা পবিত্র শাস্ত্রে যেভাবে ফুটে ওঠেছে তার মধ্যে ভাববাদী যিশাইয়ের ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যেই সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভাবে পাওয়া যায়। এখানে আমরা দেখতে পাই সেই শিশু যিনি কুমারীর গর্ভে জন্ম নেবেন, যাঁকে শান্তিরাজ, সনাতন পিতা, বিক্রমশালী ঈশ্বর বলে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁকেই আবার উৎসর্গের এক মেষশিশু হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, যিনি আমাদের অধর্মের জন্য, আমাদের পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য উৎসর্গ হচ্ছেন আর তাঁরই রক্তের গুণে আমাদের ধার্মিক বলে প্রতিপন্ন করা হচ্ছে।
ভাববাদী যিশাইয় যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন এবং উৎসর্গের যে দৃশ্য তিনি অঙ্কন করেছেন ঠিক সেই ভাবে যীশু খ্রীষ্ট আমাদের জন্য— আমাদের পাপের ক্ষমার জন্য— আমাদের পরিত্রাণের জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গকৃত হিসাবে বিলিয়ে দিলেন। যদি তিনি তা না দিতেন তবে আমরা আজও পাপের অন্ধকারে থাকতাম— মুক্তির স্বাদ পেতাম না। আমরা জানতে পারতাম না যে, আমরা অনন্ত জীবনে কখনো প্রবেশ করতে পারব কি পারব না। আমাদের শহীদদের রক্ত যেমন ভাষার জন্য মূল্য দিয়েছেন ঠিক তেমনি যীশু খ্রীষ্টের আত্মত্যাগ আমাদেরকে পিতা ঈশ্বরের সংগে মিলিত হবার জন্য যে বাধা ছিল, যে দূরত্ব ছিল, তা অপসারিত করেছে। এখন ঈশ্বরের কাছে যাবার কোন বাধা আমাদের নেই। এখন যীশু খ্রীষ্টের মধ্য দিয়ে আমরা ঈশ্বরের সেবা করতে পারি, তাঁর বাধ্য হয়ে চলতে পারি এবং একটি ধার্মিকতায় পূর্ণ জীবন কাটাতে পারি। আর এজন্যই ভাববাদী যিশাইয় লিখেছেন,
“আমাদের পাপের জন্যই তাঁকে বিদ্ধ করা হয়েছে;
আমাদের অন্যায়ের জন্য তাঁকে চুরমার করা হয়েছে।
যে শাস্তির ফলে আমাদের শান্তি এসেছে সেই শাস্তি তাঁকেই দেওয়া হয়েছে;
তিনি যে আঘাত পেয়েছেন তার দ্বারাই আমরা সুস্থ হয়েছি। (যিশাইয় ৫৩:৫)
পবিত্র শাস্ত্রের অংশটুকু একটু গভীরভাবে ভেবে দেখুন। মুক্তির ইতিহাসে এই সত্য কত না চরমভাবে ফুটেওঠেছে! লেখা আছে, “তবু আমরা মনে করলাম, তিনি আহত, ঈশ্বর কতৃর্ক প্রহারিত ও দুঃখার্ত।” একটু ভেবে দেখুন, যীশু খ্রীষ্টের জীবনে এই সত্য কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে! জন্মের পর থেকেই যিনি ইস্রায়েলীয়দের সমাজ ব্যবস্থায় এতটা প্রভাব বিস্তার করলেন, হাজার হাজার আম জনতা যাঁকে একটু দেখবার জন্য, তাঁর কথা শুনবার জন, তাঁকে একটু ছুঁয়ে দেখবার জন্য তাঁর পেছনে পেছনে যেত, তাদের রোগীরা তাঁর মুখের কথায় সুস্থ হয়ে নতুন জীবন লাভ করতো, অভুক্তরা তাঁর দেওয়া খাবার খেয়ে চরম তৃপ্তিলাভ করতো, তাঁর মুখের বাণী শুনে অনন্ত জীবনের পথ আবিস্কার করতো— সেই তারাই কিন্তু পিলাতের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছে, ‘ওকে ক্রুশে দাও, ওকে ক্রুশে দাও, ওর বেঁচে থাকা উপযুক্ত নয়। ওর পরিবর্তে বারব্বাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দাও।’
এই লোকেরাও মনে করেছিল ঈশ্বর ওকে শাস্তি দিচ্ছেন, ওর শাস্তি পাওয়া উচিত। কিন্তু তারা কখনও মনে করে নি যে, এর মধ্য দিয়ে ভাববাদী যিশাইয় যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তা-ই সত্য হয়ে দেখা দিচ্ছে। কেন এমনটা ঘটেছিল? কেন এই লোকেরা পাল্টি খেল? পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, এর পেছনে একটি রাজনৈতিক সত্য আছে।
আপনারা নতুন নিয়মের সুখবরের চারটি পুস্তক পাঠ করলে বুঝতে পারবেন যে, লোকদের মনে— বিশেষ করে তৎকালীন যিহূদীদের মনে খ্রীষ্ট একজন আধ্যত্মিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি তাদের অ-যিহূদী জাতির হাত থেকে মুক্ত করবেন— বিশেষ করে রোমীয়দের হাত থেকে। তারা শত শত বছর ধরে এই খ্রীষ্টের জন্য অপেক্ষা করছিল। তারা মনে করেছিল সেই খ্রীষ্ট এসে গেছেন। আমরা তার প্রতিধ্বনি দেখতে পাই যীশু যখন যিরূশালেমে আগমন করছিলেন তখনকার দৃশ্য দেখে। তারা তাঁকে বরণ করে নিয়েছিলেন তাদের রাজধানীতে একজন ‘রাজা’ হিসাবে। কিন্তু যীশু তাদের বরণ করা খ্রীষ্ট হিসাবে লোকদের প্রত্যাশা পূরণের কাজ করেন নি। তিনি রাজনৈতিক মুক্তির কোন কর্মসূচিই হাতে নেন নি। তিনি রাজপ্রাসাদ দখল করার পরিবর্তে বিকেলেই রাজধানী ছেড়ে চলে গিয়ে রাজধানীর বাইরে গিয়ে রাত কাটালেন। এটা তৎকালীন যিহূদীদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না।
এতদিন তিনি ইস্রায়েলীয় দেশের নানা জনপদে সময় কাটিয়েছেন— অনন্ত জীবনের নানা শিক্ষায় তাদের সমৃদ্ধ করেছেন, নানা আশ্চর্য কাজ দিয়ে তাদের মন ভরিয়ে রেখেছেন। ঐসব লোকেরা খুব বেশী রাজনৈতিক সচেতন ছিল না কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে আত্মিক দিকে তাদের মন আরো বেশী কার্যকর ছিল। আমাদের দেশের গ্রাম-গঞ্জের লোকদের দিকে তাকালেও সেই একই সত্য দেখা যাবে।
কিন্তু যীশু খ্রীষ্ট তার শিষ্যদের নিয়ে এখন যিরূশালেমে আসছেন। যিরূশালেমে আসার আগে তিনি এক ভয়ংকর অলৌকিক কাজ করেছেন। তিনি চার দিনের মৃত লাসারকে জীবিত করে তুলেছেন। এই কথা রাজধানী যিরূশালেম সহ আশেপাশের অনেক জায়গায়ই ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই লোকদের মনে এক গভীর প্রত্যাশা জেগে ওঠেছিল যে, ইনিই সেই খ্রীষ্ট যার জন্য তারা অপেক্ষা করছে। তিনিই সেই জন যিনি তাদের জীবনে রাজনৈতিক মুক্তি নিয়ে আসবেন। এটার প্রতিফলনই আমরা দেখতে পাই যখন তিনি যিরূশালেমে প্রবেশ করেছিলেন— হাজার হাজার আমজনতা তাঁকে রাজধানীতে স্বাগত জানিয়েছিল যেমন করে একজন রাজাকে স্বাগত জানায়। রাজধানীর এই লোকেরা ছিল রাজনৈতিক সচেতন। তারা আত্মিক দিকে থেকে রাজনৈতিক দিক বেশী বিবেচনায় নিত কারণ তারা রোমীয় রাজপ্রতিনিধির সঙ্গে রাজধানীতে বসবাস করতো। এই রাজধানীতেই পবিত্র মন্দির বা তাদের জাতীয় উপাসনালয় ছিল যা রাজা শলোমন প্রথমে তৈরি করেছিলেন, ব্যাবিলনের বন্দিদশা থেকে ফিরে আসার পর আবার তা তৈরি করা হয়েছিল এবং নতুন নিয়মের যুগে মহান হেরোদ আবার তা নির্মাণ করেছিল। এই উপাসনালয়কে ঘিরে যতনা আত্মিক বিষয় ঘটতো তারচেয়ে রাজনৈতিক বিষয় বেশী ঘটতো। এর কারণ ছিল এর সঙ্গে ক্ষমতা ও নেতৃত্ব যুক্ত ছিল। আর যেখানে ক্ষমতা ও নেতৃত্ব ও নেতৃত্বে যাওয়ার দ্বন্দ থাকে সেখানে আত্মিকতা মৃতপ্রায় থাকে।
যীশুকে যারা রাজধানীতে স্বাগত জানিয়েছিল তারা লক্ষ্য করেছিল যে, যীশু রাজপ্রাসাদে না গিয়ে প্রায়ই উপাসনালয়ে এসে লোকদের শিক্ষা দিচ্ছেন— এখানেও তিনি অসুস্থদের সুস্থ করছেন ও উপাসনালয়ের পবিত্রতার বিষয়ে রেডিক্যাল একশনে যাচ্ছেন কিন্তু তিনি রোমীয় সরকারের বিরুদ্ধে কোন কথাই বলছেন না এবং তাঁর কোন কর্মসূচির মধ্যেই ক্ষমতা দখল করার কোন পদক্ষেপ নেই। যা আছে তা পুরোটাই আধ্যাত্মিক বা আত্মিক বিষয়াবলি— আত্মিক মুক্তির বিষয়েই তাঁর কর্মসূচি চলছে। এই বিষয়টিকে মন্দিরের মহা-পুরোহিত, প্রধান পুরোহিতগণ ও সাধারণ পুরোহিতগণ ভাল চোখে দেখে নি, কারণ রাষ্ট্রীয় আত্মিক বিষয়গুলো তারাই দেখাশুনা করে থাকে আর এর সঙ্গে তারাই রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করে থাকেন। তাই তারা খুব সহজেই লোকদের ক্ষেপিতে তুলতে পেরেছিল। তারা লোকদের বুঝাতে সমর্থ হয়েছিল যে, এই যীশু সেই খ্রীষ্ট নন যার জন্য তারা অপেক্ষা করছে। সুতরাং এই যীশুকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই। বরং তাঁকে সরিয়ে দিতে পারলে তাঁর এই আত্মিক মুক্তির আন্দোলনও থেমে যাবে। আর সত্যি কথা বলতে কি, রাজধানিতে বসবাসকারী রাজনৈতিক সচেতন লোকেরা এই পরামর্শে সাড়া দিয়েছিল এবং ধমীর্য় নেতারা তাদেরকে যীশুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলতে সমর্থ হয়েছিল। যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই শত শত আমজনতা চিৎকার। “ওকে ক্রুশে দাও, ওকে ক্রুশে দাও” বলে তারা শ্লোগানে শ্লোগানে পিলাতের আদালত কাঁপিয়ে তুলেছিল।
এটা এমন একটা সময় ঘটেছিল যখন নিস্তার-পর্ব ও নিস্তার-পর্বের ভোজ উপস্থিত হয়েছিল। যীশুর তাঁর সময় বুঝতে পেরে তাঁর শিষ্যদের নিয়ে এই ভোজ খেলেন কারণ এটাই ছিল সেই উপযুক্ত সময় যখন তিনি ভাববাদী যিশাইয়ের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে নিজের জীবন উৎসর্গ করবেন। সেই জন্য তিনি খেতে বসে তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন ‘এই রুটি তাঁর দেহ’ ও ‘এই আঙ্গুর রস তাঁর রক্ত’ যা নতুন নিয়মের জন্য— তাদের মুক্তির জন্য দেওয়া হবে।
উপসংহার:
তিনি আমাদের মুক্তির জন্য তাঁর দেহ ও রক্ত দান করলেন। যারা তাঁর উপর বিশ্বাস করে এখন তাদের আত্মিক মুক্তি অর্জিত হয়। তিনি একদিন রাজনৈতিক মুক্তিও নিয়ে আসবেন বটে। তবে সেই সময়টা ছিল আমাদের আত্মিক মুক্তির সময়। ‘আমাদের শান্তিজনক শাস্তি তার উপর নেমে আসলো আর তাঁর ক্ষতগুলো দ্বারা আমাদের আরোগ্য হল।’ এভাবেই ‘একুশ’ আমাদের মনে করিয়ে দেয় কিভাবে বড় কিছু অর্জনের জন্য ‘রক্ত’ দিয়ে তা অর্জন করতে হয়। রক্তের বিনিময়ে আমরা মায়ের ভাষা পেয়েছি আর যীশু খ্রীষ্টের রক্তের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের পাপের ক্ষমা পেয়ে থাকি। আমেন।